জেএনইউয়ে হামলা এবং পুলিশের ভুমিকা
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের
ক্যাম্পাস থেকে ভীত সন্ত্রস্ত শিক্ষার্থীরা যখন থানায় ফোন করে প্রাণরক্ষার জন্য পুলিশের
কাছে সুরক্ষা চায়, তখন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পুলিশের কি কর্তব্য হতে পারে? এই প্রশ্নের
উত্তরেও যদি বিতর্ক গড়ে ওঠে, তবে বুঝতে হবে দেশের ভিতর অনৈতিকতার শিকড় অনেক গভীরে প্রবেশ
করেছে। দেশবাসীর একটা বড়ো অংশের ভিতর মানবিকতা নামক প্রকৃতির অপমৃত্যু হয়েছে। মনে রাখতে
হবে, মাত্র কিছুদিন আগেই, সেই দিল্লীরই জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে
ঢুকে পুলিশি হামলায় শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করার অপচেষ্টা হয়েছিল।
এবং সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে থেকে ক্যাম্পাসে ঢোকার অনুমতি নেওয়ার অপেক্ষাও
করে নি রাষ্ট্রের পুলিশ। অথচও এই পুলিশই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের
কাছ থেকে প্রাণরক্ষার জন্য ফোন পেয়েও উপাচার্য্যের অনুমতির অপেক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের
গেটের বাইরে ঘন্টার পর ঘন্টা নিধিরাম সর্দারের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। এবং ক্যাম্পাসের ভিতর
বহিরাগত সন্ত্রাসীদের বেলাগাম হামলা চালিয়ে যেতে মদত দিল।
না পুলিশের ভুমিকা
এখানেই শেষ নয়। এবং শুধু পুলিশই নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সুরক্ষা বাহিনীরও বিশেষ
ভুমিকা রয়েছে জানুয়ারীর পাঁচ তারিখে জেএনইউএর ঘটনায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রছাত্রী
অধ্যাপক অধ্যাপিকা নিজস্ব পরিচয়পত্র দেখিয়ে তবেই ক্যাম্পাসের ভিতর ঢোকার অনুমতি পান।
সেখানে পঞ্চাশ একশ জনের গুণ্ডাবাহিনী কোন পরিচয়পত্র দেখিয়ে সিকিউরিটির অনুমতি নিয়ে
ক্যাম্পাসে ঢুকতে সক্ষম হয়েছিল? এবং সেই একই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বাইরে
প্রহরারত পুলিশের ভুমিকাই বা কি ছিল? এবং ক্যাম্পাসের ভিতর সিকিউরিটি বাহিনী কার নির্দেশে
সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয় ছিল্? একজন দুজন নয় পঞ্চাশ একশ জনের গুণ্ডাবাহিনী। বিস্তর টালবাহানার
পর পুলিশ যখন ক্যাম্পাসে ঢুকলো, একজন অপরাধীকেও গ্রেফতার করলো না কেন? অপরাধীরা এই
বিশাল পুলিশবাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে গেল কোন জাদুতে? নাকি অপরাধীদের নিরাপদে
পালাতে সাহায্য করার জন্যেই ঘন্টা চারেক পর পুলিশের প্রবেশ ক্যম্পাসে? পরিকল্পনা মাফিক
সফল ভাবে হামলা সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর? গোটা ঘটনায় উপাচার্যের ভুমিকাই বা কি ছিল? কেন
তিনি ক্যম্পাসে ঘন্টার পর ঘন্টা গুণ্ডাবাহিনীকে অবাধে তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে
দিলেন? এ কেমন উপাচার্য? শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার থেকেও যার কাছে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা
বড়ো হয়ে দেখা দেয়?
কে কাকে মেরেছে, কোন
ঘটনার প্রেক্ষিতে এই হামলা হয়েছে, মূল বিষয় সেটি নয়। মূল বিষয়, একটি সুরক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের
ক্যাম্পাসে সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনী মুখে কাপড় বেঁধে কি করে প্রবেশ করতে পারে অবাধে? এর
জবাব কে দেবে? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ? ক্যাম্পাসের সিকিউরিটি? দিল্লী পুলিশ? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক?
সমগ্র ঘটনায় ক্যাম্পাসে বহিরাগত গুন্ডাবহিনী, ক্যম্পাসে কর্তব্যরত সিকিউরিট, দিল্লীর
পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ভুমিকার ভিতর সুস্পষ্ট একটি যোগসাজগই ফুটে ওঠে।
আর সেই চিত্রই যদি সত্য হয়, তবে বিষয়টা ভয়াবহ। এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যলয়েও এইরকমের
ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়াই স্বাভাবিক। যদি না এখনই এই ধরনের অশুভ আঁতাতকে প্রতিরোধ করা
যায়।
এই প্রসঙ্গে স্মরণ
করা যেতে পারে ২০০২ এর গুজরাট দাঙ্গার কথা। সেই সময় ঠিক একইভাবে রাজ্যের পুলিশকে প্রশাসনিক
ভাবে প্রায় তিনদিন নিস্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল যাতে দাঙ্গাবাজরা অবাধে লুঠপাট চালিয়ে
খুন জখম করে অগ্নিসংযোগ করে প্রমাণ লোপাটের কাজ করতে পারে সুষ্ঠ ভাবে। ক্ষমতাসীন সরকার
যখন গুণ্ডাবাহিনীর মদতে থাকে, তখন আক্রান্ত জনগণের বাঁচার আর কোন উপায় থাকে না। গুজরাটে
ঠিক সেটাই হয়েছিল। কাদের মদতে হয়েছিল সেটা দেশবাসীর অজনা নয়। তারা এখন কোন ক্ষমতার
গদিতে আসীন, সেটাও বিশ্ববাসীর অজানা নয়। ফলে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় পুলিশের
ভুমিকা ও ক্যাম্পাসের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সিকিউরিটির ভুমিকার নেপথ্যের কারণ নিয়েও কোন
বিতর্ক থাকার কথা নয়।
৭ই জানুয়ারী ২০২০
কপিরাইট পোস্টমর্টেম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন